Saturday, February 6, 2016

অধরা স্বপ্ন


মো.ফয়সাল উদ্দিন: দূর্বা ঘাসগুলোর উপর বিন্দু বিন্দু শিশির কনা জমে আছে। খালি পায়ে ঘাসের উপরে হাটলে পায়ের পাতায় মরা ঘাসের পাতাগুলো লেগে যায়।

একটা শিরশির ভাব সাড়া গায়ে লেগে থাকে। স্কুলে যাবার রাস্তা এই একটাই। ঘাসের উপর দিয়েই যেতে হবে। দিনে এক বেলা খাবার খাওয়া যার জন্য কষ্টকর তার কাছে এক জোড়া স্যান্ডেল স্বপ্নের মতন। রাস্তার ধারে বেঁধে রাখা গরুটার দুধ খেয়ে যায় ছোট বাছুরটি। আত্মমগ্ন হয়ে দুই বছর আগে ফিরে যায় রিনিল। তার বয়স তখন পনেরো। তার ছোট বোন তার মায়ের বুকের সাথে এভাবেই লেগে থাকতো ক্ষুধার সময়। এক ফোঁটা দুধের জন্য কত কান্না করতো। মায়ের বুকে দুধ ছিল না। এক বেলা খেলে কি আর বুকে দুধ আসে? নিজেকে প্রশ্ন করে রিনিল। স্বপ্নগুলো ছোট হয়ে আসে দারিদ্রের আঘাতে।

গ্রামের মুক্ত পরিবেশে জন্ম হলেও নিজেকে মুক্ত ভাবতে পারে নি রিনিল। জন্মের দুই বছরের মাথায় তার বাবা মৃত্যু বরণ করে। মায়ের রুগ্ন শরীরে কষ্টের চিহ্নগুলো মনে পড়লে গা শিউড়ে ওঠে। দূর্বা ঘাসের রাস্তা পেড়োয়ে মেইন রোডে এসেই পেটের মধ্যে একটা মোচর দেয়। আজকে খাওয়া হয় নি সকালে। রাস্তার শক্ত পাথরের চাইগুলো পায়ের নিচে হাঁটার তালে তালে সজোরে আঘাত করে। এই বুঝি জান বেরিয়ে গেল। পথের যে এখনো অনেক বাকি। পা দুটো জোরে করেই টেনে নিয়ে চলে রিনিল। অদম্য ইচ্ছাশক্তির বলেই রাস্তার পাথর, পেটের ক্ষুধা আর দারিদ্রকে পিছনে ফেলে স্কুলে যাত্রা তার। বাস স্ট্যান্ডের রাস্তায় এসে পেটের মোচড়টা একটু ঘন হয়ে ওঠে। চো চো করতে থাকে। মাথাটা ঘুরে। এই বুঝি পড়ে যায় সে। 

রাস্তার পাশের খাবারের দোকান থেকে রুটি আর সবজির গন্ধ তাকে অর্ধ আহারের সুখ দেয় কিন্তু পেট শুন্যই থাকে। আর মিষ্টির দোকানের গরম মিষ্টিগুলো কালো কড়াইয়ের মধ্যে রসে টই টই করে। জিবে জল আসে রিনিলের। নিজেকে কাচের উপরে মিষ্টির নেশায় ছুটে আসা কিন্তু আটকে পড়া মাছির মতো মনে হয়। একবার যদি ঢুকতে পারত ওই কাচ ভেদ করে! কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দে সম্ভিত ফিরে পায়। স্কুলের সময় হয়ে গেছে। স্কুলের শুরুটাই তার জন্য কষ্টের। অ্যাসেম্বলির সময় স্যার জুতা চেক করেন। আর এই প্রতিদিন প্রথম ক্লাসটা করা হয় না। রোদে হাঁটু গেড়ে দাড়িয়ে থেকেই সময় পার করতে হয়। হেডমাস্টারের নজরে পড়লে শাস্তির মাত্রাটা একটু কমে। তবে গড়ে সপ্তাহে তিন দিনই এমন শাস্তি পায় সে। অভ্যেস হয়ে গেছে।

এই সময়টাতে সে ভাবে, যদি এক জোড়া জুতা থাকতো তার তাহলে গ্রামের রাস্তার কাদাময় মাঠেও সে দৌড়ে যেত। একটুও কাদা লাগতো না পায়ে। দুপুরের পিচঢালা গরম রাস্তায় পা পুড়ে যেত না তার। স্কুলের ছাত্রদের মুখের দিকে না তাকিয়ে জুতার দিকে তাকানোই তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আর তালি মারা শার্ট নিয়ে তেমন আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ শুধু জুতা নিয়েই। আর এই স্বপ্নের ঘোড়েই ভাবে, তার বাবার মৃত্যু না ঘটলে আজকে তার পায়ে জুতা থাকতো। মায়ের শরীরের হাড়গুলো শুকিয়ে যেত না। ছোট বোনটি অনাদর আর অবহেলায় মাটির আবরন গায়ে মাখত না। স্কুলের রাস্তায় বুক ফুলিয়ে হেঁটে যেত সে। হাটের দিনে বাবার হাত ধরে ময়রার দোকানের সব পছন্দের মিষ্টি খেত। কিন্তু স্বপ্ন গুলো স্বপ্নই থেকে যায়।


No comments:

Post a Comment